পর্ব-৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের আদ্যোপান্ত

এই পর্বে আমরা আলোচনা করব বায়োফ্লক ট্যাংকের আয়তনের উপর ভিত্তি করে পানির পরিমান নির্ণয় এবং ট্যাংক স্থাপন।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গেলে পানির সকল উপাদান আদর্শ পরিমানে রাখতে পানিতে ব্যবহৃত সকল উপকরণ যেমন: চুন, লবণ, চিটাগুড়, প্রোবায়োটিকস্ ইত্যাদি নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করতে হয়। এই সকল উপকরণের ব্যবহার মাত্রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পানির পরিমানের উপর নির্ভর করে। তাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য পানির পরিমান জানা খুবই জরুরী।

আগের পর্বে আমরা আলোচনা করে ছিলাম বায়োফ্লক সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে ছোট আকারের ট্যাংকে এই পদ্ধতিতে চাষ করে পুরো বিষয়টি আয়ত্তে আসলে পরবর্তীতে বড় পরিসরে চাষ শুরু করা যেতে পারে। আগের দুটি পর্ব যদি দেখে না থাকেন তবে নিচের লিংক থেকে দেখে নিন।



বায়োফ্লক খামার স্থাপনের জন্য পর্যায়ক্রমিক ভাবে নিম্নোক্ত কাজ গুলো সম্পন্ন করতে হবে:

ক) বয়োফ্লক প্রজক্টে এর জন্য স্থান নির্বাচন:
বায়োফ্লক খামারের স্থান হতে হবে বন্যা মুক্ত, বিদ্যুৎ সংযোগ থাকতে হবে, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পানি সরবরাহের ব্যবস্থা।

খ) বায়োফ্লক ট্যাংক এর ধরন নির্বাচন:
ট্যাংক তেরপল/তারপলিন এবং সিমেন্ট  দুই ভাবেই তৈরী করা যায়। দুই ধরনের ট্যাংকেই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। অনেকের মতে সিমেন্ট এর ট্যাংকে একধরণের কেমিক্যাল থাকে, যা বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের করতে গেলে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং ফ্লক নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য সিমেন্ট ট্যাংক তৈরীর পর ৩০-৪৫ দিন পানি ভর্তি করে রেখে দিতে হয় যাতে করে সিমেন্টের ক্যামিকেল এর প্রভাব দূর হয়। অপর দিকে তারপলিন ট্যাংকে কেমিক্যাল জনিত কোন সমস্যা হয় না বলে অনেক চাষী ভাই এই ট্যাংকে মাছ চাষ করাকে সুবিধাজনক বলে থাকেন। সঠিক পদ্ধতি অনুসরন করলে দুই ধরনের ট্যাংকেই মাছ চাষ লাভজনক। আমরা এখানে তেরপর এর ট্যাংক তৈরীর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

গ) ট্যাংকের আকার নির্ধারন:
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য বিশেষজ্ঞগণ মূলত গোলাকার ট্যাংকের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারন আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংকের কোনায় পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় ফলে ট্যাংকের কোনায় ডেড জোন বা মৃত অঞ্চল তৈরী হয়। ডেড জোনে অ্যানেরবিক অবস্থার  সৃষ্টি হয়ে ওই অঞ্চলে জমা হওয়া জৈব বর্জ্য পুনরায় নাইট্রিফিকেশ এর মাধ্যমে পুষ্টি চক্রে ফেরত আসতে পারে না ফলে পানির অ্যামোনিয়ার পরিমান বেড়ে যায়। অপর দিকে গোলাকার ট্যাংকে পানির সঞ্চালন তুলনামূলক বাধাহীনভাবে চলতে থাকে বিধায় এখানে ডেড জোন তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার গোলাকার ট্যাংকে পানির সার্কুলার প্রবাহ অব্যাহতভাবে রাখা যায় বিধায় মাছের চলাচলও অব্যাহত থাকে ফলে মাছের খাদ্য গ্রহন ও বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয়। আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংকে মাছ চাষ করা যাবে না তা নয়, কেউ যদি আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংকে মাছ চাষ করতে চান তো করতে পারেন।



ঘ) পানির ধারণ ক্ষমতা অনুসারে ট্যাংকের আয়তন নির্ণয়:
নিম্নোক্ত সূত্রের সাহায্যে আমরা ট্যাংকের পানির পরিমান জানতে পারব।

আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংকের পানির পরিমান (যদি ফুটে ট্যাংকের মাপ নেই):
ট্যাংকের পানির পরিমান = (দৈর্ঘ্য ফুট X প্রস্থ ফুট X পানির গভীরতা ফুট) X ২৮.৩২ লিটার

ধরি,
ট্যাংকের দৈঘ্য ১২ ফুট, প্রস্থ ১২ ফুট এবং পানির গভীরতা ৩ ফুট তাহলে সূত্রানুসারে ট্যাংকে আয়তন
=১২x১২x৩ =৪৩২ ঘন ফুট পানি,
আমরা জানি,
প্রতি ঘন ফুটে পানি থাকে  = ২৮.৩২ লিটার
তাহলে, ৪৩২ ঘন ফুটে পানি থাকবে  =  ৪৩২X২৮.৩২ লিটার = ১২২৩৪.২৪ লিটার পানি
এক লাইনে হিসাব হবে, ১২ X ১২ X ৩ X ২৮.৩২=১২২৩৪.২৪ লিটার

আয়তাকার বা বর্গাকার ট্যাংকের পানির পরিমান (যদি মিটারে ট্যাংকের মাপ নেই):
ট্যাংকের পানির পরিমান = (দৈর্ঘ্য মি: X প্রস্থ মি: X পানির গভীরতা মি:) X ১০০০ লিটার

গোলাকার ট্যাংকের পানির পরিমান (যদি ফুটে ট্যাংকের মাপ নেই):
গোলাকার ট্যাংকের পানির পরিমান নির্ণয়: ৩.১৪১৬ X ব্যাসার্ধ২ X পানির গভীরতা X ২৮.৩২
এখানে, (ব্যাসার্ধ (Radius) = ব্যাস(Diameter)/২); আবার (ব্যাসার্ধ২ = ব্যাসার্ধ X ব্যাসার্ধ)
ধরি,
ট্যাংকের ব্যাসার্ধ ৬ ফুট এবং পানির গভীরতা ৩ ফুট তাহলে সূত্রানুসারে ট্যাংকে পানির পরিমান হবে।
=৩.১৪১৬x৬২x৩ = ৩৩৯.২৯২৮ ঘন ফুট পানি,
আমরা জানি যে, প্রতি ঘন ফুটে পানি থাকে ২৮.৩২ লিটার। তাহলে ৩৩৯.২৯২৮ ঘন ফুটে পানি থাকে ৩৩৯.২৯২৮ X ২৮.৩২ = ৯৬০৮.৭৭ লিটার পানি।

গোলাকার ট্যাংকের পানির পরিমান (যদি মিটারে ট্যাংকের মাপ নেই):
গোলাকার ট্যাংকের পানির পরিমান নির্ণয়: ৩.১৪১৬ X ব্যাসার্ধ২ X পানির গভীরতা X ১০০০


ট্যাংকের উচ্চতা হবে ট্যাংকে পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে ১-১.৫ ফুট উচু, অর্থাৎ আমরা যদি ট্যাংকে ৩ ‍ফুট পানি রাখি তবে ট্যাংকের উচ্চতা রাখতে হবে ৪-৪.৫ফুট।

সহজে পানির পরিমান নির্ণয় করতে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন নিচের লিংক থেকে:




ঙ) ট্যাংক ও প্রয়োজনীয় উপকরন স্থাপন:
ট্যাংক স্থাপনের জন্য ধাপে ধাপে নিম্নোক্ত কাজ গুলো করতে হবে।

i) ট্যাংকের তলদেশ প্রস্তুতকরণ এবং লোহার ফ্রেম স্থাপন:

ট্যাংকের আয়তন অনুযায়ী লোহার ফ্রেম স্থাপন করতে হবে। ট্যাংক এর তলদেশ পরিধির দিক থেকে মাঝ বরাবর ক্রমশ ঢালু হবে এবং ট্যাংকের মাঝে তলদেশে একটি পানি নির্গমন নল যুক্ত করতে হবে, যাতে করে সহজে পানি পরিবর্তন করা যায়। পানি নির্গমন পথে সূক্ষ ছিদ্র যুক্ত নেট  বা নির্গমন নল স্থাপন করতে হবে। 

লোহার ফ্রেমটি তারপলিন ট্যাংকে দৃঢ়তা প্রদান করে। ১০,০০০ লিটার ধারণ ক্ষমতার একটি ট্যাংক এর ব্যাস হবে ১২ ফুট এবং লোহার খাঁচা তৈরীতে প্রায় ১০০ কেজি লোহার প্রয়োজন যার দাম ৫,০০০-৬,০০০ টাকা খরচ হয়।

ii) তেরপল এর ট্যাংক স্থাপন:
ট্যাংকের আয়তন অনুযায়ী তৈরী করা তেরপল এর ট্যাংকটি সাবধানতার সাথে লোহার বেড়ার উপর স্থাপন করতে হবে এবং দড়ি দিয়ে  লোহার বেড়ার সাথে ভালো ভাবে আটকে দিতে হবে। ট্যাংকে পানি সরবরাহের জন্য একটি নল ট্যাংকে যুক্ত করতে হবে। ১০,০০০ লিটার ৬৫০ জিএসএম এর একটি ট্যাংক এর দাম প্রায় 

৮,০০০-৮,৫০০ টাকা। একটি ট্যাংকে প্রায় ৫ বছর চাষ করা যায়। তেরপলিন ট্যাংকেটি সঠিক পরিমাপে তৈরী করা না হলে তা ভাজ হয়ে থাকবে যাতে জৈব বর্জ্য জমে থাকবে, আবার আকারে ছোট হলে ফ্রেমে সঠিকভাবে বসবে না। তাই সঠিক পরিমাপে ট্যাংক তৈরী করা জরুরী।

ii) পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের উপকরন:

প্রয়োজনীয় পরিমান পানি সরবরাহের জন্য পাম্প ও নিষ্কাশনের জন্য পানি নির্গমন নল সংযুক্ত করতে হবে।

vi) এ্যারেটর স্থাপন:
প্রতি ১০,০০০ লিটার ট্যাংকের জন্য ৭০-৮০ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এ্যারেটর এবং ১০টি ন্যানো বাবল স্টোন অথবা প্রয়োজন মত ন্যানো বাবল টিউব স্থাপন করতে হবে । এ্যারেটর অবশ্যই ট্যাংকের পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে উচুতে স্থাপন করতে হবে।


vii) বিদ্যুৎ সংযোগ:
বায়োফ্লক ট্যাংকে যেহেতু ২৪ ঘন্টা অক্সিজেন সরবরাহ করা জরুরী তাই লোডশেডিং এর সময় স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন: সেলফ স্টার্ট জেনারেটর ব্যবহার করা যেতে পারে।

viii) শেড তৈরী:
বায়োফ্লক প্রজেক্টে যাতে পর্যাপ্ত পারিমান আলো প্রবেশ করতে পারে এবং ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে প্লাস্টিকের স্বচ্চ টিন ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার শীতকালে ভিতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে গ্রীন হাউজের মত করে প্রজেক্ট এর ডিজাইন করা যেতে পারে।

Comments

  1. ভাইয়া অনেক ধন্যবাদ। কোন মাছ কি পরিমান ছাড়ব? কোন মাছ চাষ লাভজনক হবে?

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

পানির পি.এইচ নিয়ন্ত্রন

পুকুরের পানিতে অক্সিজেন ঘাটতির কারন, লক্ষণ ও প্রতিকার

পুকুরের পানিতে লালচে/সবুজ স্তর এর সমাধান