বাগদা ও গলদা আহরণ ও আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা এবং বাজারজাতকরণ

বাগদা ও গলদা আহরণ ও আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব:

চিংড়ি বাজারজাত করার পূর্বে এর গুণগতমান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আহরণ ও আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ওপর চিংড়ির গুণগতমান ও বাজার মূল্য নির্ভর করে। আহরণ হতে প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্তজরুরী ও প্রয়োজনীয়।

বাগদা ও গলদা আহরণের পূর্বে অবশ্য করণীয় কাজসমূহ:
  • প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল সংগ্রহ করা;
  • বাজার মূল্য সম্পর্কে খোজ খবর নেওয়া;
  • প্লাষ্টিক ঝুড়ি, ঝাঁকি জাল,আটল, বরফ, ওজন করার জন্য দাঁড়ি-পাল্লা ইত্যাদি সংগ্রহ করা;
  • আহরণপূর্বে চিংড়ির আকার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।

বাগদা ও গলদা আহরণের সময় করনীয় বিষয়সমূহ:
  • চিংড়ি আহরণে এমন মেস সাইজের জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে প্রত্যাশিত আকারের চেয়ে ছোট চিংড়ি বা জুভেনাইল খুব সহজেই বের হয়ে যেতে পারে;
  • ছোট আকারের চিংড়ি বা জুভেনাইল ধরা পড়লে তাড়াতাড়ি ছোট চিংড়িগুলো ঘেরে ছেড়ে দিতে হবে;
  • নরম খোলসযুক্ত চিংড়ি ধরা রোধে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার সাথে মিল রেখে আহরণ করতে হবে;
  • ভোরে অথবা ঠান্ডা আবহাওয়ায় চিংড়ি আহরণ করতে হবে;
  • আহরণের সময় চিংড়ি অধিক আঘাত পায়, অঙ্গ বিনষ্ট হয় এবং ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এমন কোনো পদ্ধতি ও সরঞ্জাম দিয়ে চিংড়ি আহরণ না করা;
  • চিংড়ি আহরণের পর পরিষ্কার পানি দ্বারা ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে যাতে কোনো কাদা বা ময়লা না থাকে;
  • আহরণকৃত চিংড়ি পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করার পর বরফ ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে রাখতে হবে;
  • মৃত ঠান্ডা চিংড়ি ১ঃ১ অনুপাত হারে বরফ সহকারে সংরক্ষন করতে হবে ।

বাগদা ও গলদা আহরণের বিভিন্ন পদ্ধতি:
চিংড়ি আহরণে সাধারনত ৪টি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো:-
  • আটল/ফাঁদ পদ্ধতি : আটল বাঁশের তৈরি এক ধরনের ফাঁদ যা ব্যবহার করে চিংড়ি ধরা যায়। এই সমস্ত আটল বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে ( ৬০ - ৭০ সেমি) । আটল ঘেরের বিভিন্ন স্থানে এবং ২.৫-৩ মি: দুরত্বে স্থাপন করাই শ্রেয় । আটল সাধারনত জোয়ারের সময় যে স্থোন দিয়ে পানি প্রবেশ ও নির্গন হয় সেই স্থানে বা ঘেরের গভীরতম স্থনে স্থাপন করা হয় । ইহা একটি সহজ ও ব্যয় সাশ্রয়ী ব্যবস্থা । পাটা বা নেটের পার্শ্বে স্থাপন করা হয়। এই ট্রাপ গোঁনের সময় ঘেরের গভীর স্থানে এবং গোঁই (ঘেরের যে স্থান দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে এবং বাহির হয়) এর ধারে স্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতি অনেক সহজ এবং কম লোকবল দরকার হয়। কা®িক্ষত আকারের মেস সাইজ ব্যবহার করলে ছোট মাছ ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
  • ঝাঁকি জাল পদ্ধতি : যখন গোঁই বা ফাঁদে ধৃত চিংড়ির পরিমাণ কমে গেলে তখন ঝাঁকি জাল ব্যবহার করে চিংড়ি আহরণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে ছোট চিংড়ি বার বার আসার সুযোগ থাকে তাছাড়া শ্রমিকও বেশি লাগে। তবে এই পদ্ধতিতে চিংড়ি ধরার ১০-১৫ মিনিট পূর্বে খাদ্য, নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে প্রয়োগ করে চিংড়ি ধরা যায়।
  • বেড় জাল পদ্ধতি : যদি ঘের আয়তনে বড় হয় এবং বেশি পরিমাণ চিংড়ি ধরার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে বেড় জাল ব্যবহার করা উত্তম। কারণ জালের দৈর্ঘ্য বেশি হলে একদিকে যেমন জাল টানা সহজ হয় এবং বেশিরভাগ চিংড়ি জালে ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে একই ঘেরে একদিনে দুই বারের বেশি বেড় জাল টানা উচিত নয়।
  • পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি : আবদ্ধ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণের জন্য শেষ বার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে ঘের শুকিয়ে অবশিষ্ট চিংড়ি ধরা হয়। এ পদ্ধতি চিংড়ি ধরার শুরু ভোরে ঠান্ডা অবস্থায় ও পরিষ্কার আবহওয়া বাঞ্চনীয়। 

আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
চিংড়ি আহরণ শুরু হতে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় পৌছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে যেসমস্ত কাজ/পরিচর্যা করা হয় তাকে আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বলা হয়।

আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাঃ
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির গুণগতমানের বিষয়ে যেসমস্ত অভিযোগ উত্থাপিত হয় তার অনেকটাই চিংড়ির ঘেরে এবং আহরণ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অসাবধানতা বা অজ্ঞতার কারণে ঘটে থাকে। আহরণের সময় থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন
ধাপে প্রয়োজনীয় পরিচর্যার অভাবেই চিংড়ির গুণগত মানের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। সুতরাং, ঘের/খামার এবং প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ঠ ধাপগুলোতে চিংড়িকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা খুবই জরুরী

আহরণ পরবর্তী করণীয় কাজ এবং সতর্কতা :
  • চিংড়ি ধরার পর পরিষ্কার ও শীতল পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করা
  • অবশ্যই চিংড়িকে একটি ছাউনির নিচে পাঁকা, মসৃন ও পরিষ্কার মেঝে অথবা পরিষ্কার প্লাস্টিক শিটের ওপর রাখতে হবে। কোনো প্রকারের বন্য প্রাণী; পশু- পাখি, বিড়াল, কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে খুবেই সতর্ক  থাকতে হবে। 
  • এরপর তাজা বা অর্ধমৃত অবস্থায় ১:১ অনুপাতে বরফ ও পানির মিশ্রণে চিলিং তাপমাত্রায় ( ০-২.২ ডিগ্রি  সে.) ৫ মিনিট রাখতে হবে। এতে চিংড়ি মরে শক্ত হয়ে যাবে এবং চিংড়ির গুনগতমান ঠিক থাকবে। এই পরিচর্যাকে চিংড়ির শীতল মৃত্যু (Chill Killing) বলে;
  • পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত প্লাস্টিকের ট্যাংক/বাক্সে চিংড়িত বরফ স্তরে স্তরে সাজিয়ে সংরক্ষন করতে হবে 
  • চিংড়ি আহরণের পর স্বল্পতম সময়ে কারখানায় সরবরাহ করতে হবে;
  • আহরণকালে ছোঁয়াচে রোগাক্রান্ত শ্রমিক ব্যবহার করা যাবে না ;
  • আহরণকৃত চিংড়ি পরিষ্কার স্বাস্থ্যমম্মত পাত্রে সংরক্ষন করতে হবে;
  • দূরবর্তী স্থানে সরবরাহের ক্ষেত্রে বরফের অনুপাত ১ঃ২ হতে হবে;
  • আহরণকৃত চিংড়ি শীতল বাক্স (Cool box)/রিফ্রিজারেশন ভ্যানে পরিবহণ করতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

পানির পি.এইচ নিয়ন্ত্রন

পুকুরের পানিতে অক্সিজেন ঘাটতির কারন, লক্ষণ ও প্রতিকার

পুকুরের পানিতে লালচে/সবুজ স্তর এর সমাধান